মিয়াজাকি-র ‘শেষ’ মুভি বলা হচ্ছে ‘দ্য বয় অ্যান্ড দ্য হেরন (২০২৩)’-কে। আসলেই তার শেষ নাকি শেষ না সে তর্ক বাদ যাক। মুভিটা এক কথায় একটা মাস্টারপিস। অবশ্য তাছাড়া কী হবে? তার সব মুভিই যে এক-একটা মাস্টারপিস। তবে ১০ বছরের এক গ্যাপ শেষে এর চেয়ে বেটার কিছুর আশা করেছিলাম আমি ব্যাক্তিগতভাবে।
১৪ জুলাই জাপানে মুক্তি পেলেও মুভিটি আন্তর্জাতিকভাবে মুক্তি পাবে ৮ ডিসেম্বর। তবে এক ভাগ্যক্রমে আমার সুযোগ হয়েছিলো দেখার।
মুভিটি নির্মাতা মিয়াজাকির পুরোনো মুভির বিভিন্ন এলিমেন্টকে একত্রিত করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পটভূমিতে রচিত হয়েছে। এতে মিয়াজাকির স্পিরিটেড অ্যাওয়ে (২০০১)-র আত্মার জগতে অ্যাডভেঞ্চার, হাউল’স মুভিং ক্যাসল (২০০৪)-র ম্যাজিক্যাল ক্যাসেল, দ্য উইন্ড রাইজেস (২০১৩)-র গল্পাংশ সহ এরকম কিছু এলিমেন্টগুলো খুব ভালোভাবে লক্ষ্য করতে পারবেন। নির্মাতার সব মুভিতে মূলচরিত্র মেয়ে থাকলেও এবার থাকছে ছেলে।
গল্পটি মাহিতো মাকি নামের এক বালককে নিয়ে। সে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বোমা বিস্ফোরিত টোকিও থেকে যাত্রা শুরু করে এবং এমন একটি জায়গায় গিয়ে পৌঁছায় যেখানে সে তার চেয়ে আকারে বড় বিশাল আকৃতির গোলাপী রঙের প্যারাকিট (একধরণের টিয়া পাখি) দেখতে পায়। এই মুভিটি সম্ভবত মিয়াজাকির সবচেয়ে বড় এবং সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক কাজ হিসাবে বিবেচনা করা যেতে পারে।
মুভিটি শুরু হবার পর তাৎক্ষণিকভাবে খুব ভালো নাও লাগতে পারে কিন্তু নির্মাতা খুব যত্ন সহকারে অনেকগুলা স্তরে মুভিটিতে ক্র্যাফ্ট করেছেন এবং পুরো অভিজ্ঞতাটিকে শেষ পর্যন্ত সত্যিই আশ্চর্যজনক করে তুলেছেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মহিতোর মা যেই হাসপাতালে কাজ করতো তাতে বিস্ফোরণের ফলে আগুন ধরে যায়। মহিতো তার মা-কে বাঁচাতে ছুটলেও শেষ পর্যন্ত হাতপাতলটি ভেঙে পড়ে এবং তার মা মারা যায়। এদিকে তার বাবা যুদ্ধ বিমান তৈরির এক কোম্পানিতে কাজ করে এবং তার স্ত্রীর মৃত্যুর বছর বাদে মাহিতোর মায়ের ছোট বোন নাটসুকোকে বিয়ে করে। ছেলেটির একাকীত্ব ছিলো স্পষ্ট, মিয়াজাকি কতটা উজ্জ্বলভাবে জীবনের চরিত্রগুলিকে সাহসী রূপরেখায় দৃশ্যত উপস্থিত করে তার আরেকটি উদাহরণ।
মুভিটির অ্যানিমেশন, কালার শ্যাডো সবছিলো এক কথায় অসাধারণ। স্টুডিও জিবলি-র টিপিক্যাল ক্রিয়েচারে মতো না হলেও হেরনে পাখার স্বতন্ত্র নীল-ধূসর রং ছিলো চোখ আটকে রাখার মতো। মুভিটির প্রতিটি ফ্রেশ যেন শিল্পির আঁকা এক মাস্টারপিস।
মাহিতো তার মা-কে স্বপ্ন দেখে, তার মুখ জ্বলন্ত শিখার আড়ালে, তাকে ডাকছে, “মাহিতো, আমাকে বাঁচাও।” একদম অসাধারণ ছিলো ব্যাপারটা! মাহিতোর তার মৃত মায়ের সাথে পুনরায় মিলিত হওয়ার হৃদয়বিদারক আকাঙ্ক্ষা ছিলো একদম হিট করার মতো। মুভিটি প্রতিটি কোণে রয়েছে নতুন করে বিশ্লেষণ করার মতো এলিমেন্ট। আমি যত মুভিটি নিয়ে ভাবছি তত অর্থবোধ হয়ে উঠছে।
মুভিটি গেঞ্জাবুরো ইয়োশিনোর লেখা ১৯৩৭ সালে প্রকাশিত উপন্যাস Kimi-tachi wa Do Ikiru ka (How Do You Live?) থেকে অনুপ্রাণিত আর মুভিটিতে মাহিতোর জন্য তার ময়ের রেখে যাওয়া বইটিও ছিলো এই বইটি। আমি বইটি পড়ে তারপর রিভিউ লিখতে চেয়েছিলাম কিন্তু পড়া হয়ে ওঠে নি ব্যাস্ততায়। মাহিতোর মনে “তুমি কীভাবে বাঁচবে?” প্রশ্ন ওঠে শেষের দিকে যা ছিলো এই বইয়ের ইনফ্লুয়েন্সে। মুভিটির পুরো থিমটাই অসাধারণ ছিলো।
হেরন পাখি এক কটকটে লোকের কন্ঠে মাহিতোর সাথে কথা বলে এবং তাকে তার পূর্বপুরুষ দ্বারা নির্মিত এক পাথরের টাওয়ারের দিকে নিয়ে যায়। ঠিক তারপরই অদৃশ্য হয়ে যায় হেরনটি। হেরন দাবি করে ওই টাওয়ারে তার মা এখনও বেঁচে আছে। এই দৃশ্যটি খুব বেদনাদায়ক ছিলো। এরকম অনেক অসাধারণ গল্পের মাধ্যমে এগিয়ে গেছে মুভিটি।
মিয়াজাকির গল্প বলার শৈলী এতই অনন্য যে সে প্রচলতি থ্রি-অ্যাক্ট কাঠামো অনুসরণ করার পরিবর্তে তার কল্পনাকে অনুসরণ করেছেন। ফলে গল্প কখন কোনদিকে মোড় নিবে তা অনুমান করা বেশ অসম্ভব ছিলো তবে প্লট টুইস্টগুলো ঠিকই অনুমান করা যাচ্ছিলো। যা আমার কাছে হতাশার মনে হয়েছ।
মুভির অসাধারণ ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর, সাউন্ড ইফেক্ট মুভিটিকে আরো উপভোগ্য করে তুলেছে। তবে মিউজিক আরো বেটার হতে পারতো। আমার চোখে মুভিটির তেমন কোনো নেগেটিভ দিক চোখে পড়ে নি। তবে ফ্যান্টাসি ওয়ার্ল্ডের কালার আরো একটু ভাইব্রেন্ট হলে মুভিটির বাকি কালার থিমের সাথে আরো বেশ ভালোভাবে যেতো। গল্পটার প্রথমে স্লো স্টার্ট বেশ বিরক্ত লাগছিলো প্রথমদিকে কিন্তু শেষে সেই অভিযোগ নিঃশেষ হয়ে গিয়েছে। তবে গল্পটা আরো ভালো করার জায়গা ছিলো। মিয়াজাকির আগের কাজগুলার সাথে একই সুত্র গাঁথা ব্যাপারটা আমার কাছে কিছুটা হতাশাজনক।
একটি অসাধারণ মুভির জন্য যতগুলো এলিমেন্ট প্রয়োজন তার সবগুলোকে মিয়াজাকি ঢেলে দিয়েছেন মুভিটিতে। মুভিটি একবার দেখে কোনভাবেই তৃপ্তি মিটবে না।
ব্যাক্তিগতভাবে মুভিটির রেটিং আমি দিবো ৯/১০
রিভিউয়ার: তানভীর রানা রাব্বি, ওটাকু বাংলা
অসাধারণ নিরপেক্ষ রিভিউ। খুব ভালো লিখেছেন। আমার খুব ইচ্ছা মুভিটা দেখার তবে কবে নাগাদ দেখতে পারবো জানিনা। ঘিবলির সব মুভি আমার ভীষণ পছন্দের। রিভিউ দেখার পর তো আর সইছে না!